শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশে আলো ছড়াচ্ছে ‘শিশু যত্ন কেন্দ্র’

by শেরপুর কণ্ঠ ডেস্ক
5 মিনিটের পড়া

শেরপুর কন্ঠ ডেস্ক : সমাজ ভিত্তিক সমন্বিত “শিশু যত্ন কেন্দ্র” শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশে আলো ছড়াচ্ছে । একই সাথে দিনের বেলায় নিরাপদে শিশুকে রেখে, নিশ্চিন্ত মনে নানা কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন কর্মজীবী মা-বাবা। বিশেষ করে শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৯ টা থেকে ২ টা পর্যন্ত বাসায় বা কর্মস্থলে ব্যস্ত মা-বাবা তাদের শিশুদের প্রতি খেয়াল না রাখার কারণে পানিতে ডুবে মারা যাওয়াসহ নানা দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাচ্ছে।
বাংলাদেশ মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এর অধীনে সমাজভিত্তিক সমন্বিত শিশুযত্ন কেন্দ্রের মাধ্যমে শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ ও সুরক্ষা এবং সাঁতার সুবিধা প্রদান (আইসিবিসি) প্রকল্পের তত্ত্বাবধানে টিএমএসএস এ ‘শিশু যত্ন কেন্দ্র’ পরিচালনা করছে।
আইসিবিসি সূত্র জানায়, এই ‘শিশু যত্ন কেন্দ্র’ দেশের ১৬ টি জেলার ৩৫টি উপজেলায় কাজ করে যাচ্ছে। এর মধ্যে শেরপুর জেলার তিনটি উপজেলায় মোট ৫০০ টি এই শিশু যত্ন কেন্দ্র রয়েছে।
প্রতিটি যত্ন কেন্দ্রে ১ বছর থেকে ৫ বছর বয়সের ২৫ জন শিশুকে সকাল নয়টা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত যত্ন সহকারে নিরাপদে রাখা হয়। এ শিশু যত্ন কেন্দ্রে একজন যত্নকারী ও একজন সহকারী যত্নকারী শিশুদের দেখাশোনা করে। এ সময় তারা শিশুদের বিভিন্ন অ্যাক্টিভিটিস এর মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিক বিকাশে নানান কলা কৌশল গ্রহণ করেন। বিশেষ করে এসব শিশু খেলার ছলে প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে। খেলাধুলা, শিক্ষা, সৃজনশীল কার্যকলাপ, এবং অন্যান্য বিনোদনমূলক কার্যক্রম রয়েছে এই শিশু স্বপ্ন কেন্দ্রে।
২০ জুলাই ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল উপজেলার কাঁঠাল ইউনিয়নের ধলাইমান হাজী বাড়ি শিশু যত্ন কেন্দ্র সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দুই বছর থেকে পাঁচ বছর বয়সের শিশুরা বেশ উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে খেলা করছে। সেই সাথে খেলার ছলে শিশুরা প্রাক-প্রাথমিকের পড়াশোনার পাঠও করে যাচ্ছে।
এখানে খেলাধুলার একপর্যায়ে কোনো শিশুর ঘুমিয়ে পড়লে ‘আপন ভুবন’ নামে স্থানে রাখা হয়। এছাড়াও স্বপ্নের ভুবন, গল্পের ভুবন, রঙিন ভুবন ও বাইরের ভুবন নামে মোট পাঁচটি কারিকুলামে শিশুদের নানা উৎসাহ, আনন্দ ও মেধা বিকাশে সহায়তা করে যাচ্ছেন শিশু যত্ন কারী ও সহকারী শিশু যত্ন কারী।
এ বিষয়ে ধলাইমান গ্রামের আমিনা খাতুন জানায়, আমাদের এখানে শিশু যত্ন কেন্দ্র হওয়াতে আমাদের অনেক সুবিধা হয়েছে। বাচ্চাদের এখানে রেখে বাড়িতে আমরা অনেক কাজ করি। বাড়িতে গরু-ছাগলের দেখাশোনা সহ সকল কাজকর্ম আমরা নিশ্চিন্ত মনে করতে পারি। শিশু যত্ন কেন্দ্রে আমাদের ছেলেমেয়েরা রাস্তা থেকে নিরাপদে থাকে। বাচ্চারা এখানে পড়াশুনা করে, ভালো ভালো কথা শিখে, আর্ট শিখে, ছড়া শিখে, কথা বলা শিখে, লেখা পড়া করে। এখানে ছড়া শিখে বাড়িতে গিয়ে আমাদের ছড়া শোনার।
একই গ্রামের তন্নী আক্তার বলেন, আমি এখানে আমার বোনের ছেলেকে নিয়ে এসেছি, বোন ও দুলাভাই দু’জনই খুব ব্যস্ত তাই প্রায় প্রতিদিনই আমার ভাতিজাকে এই কেন্দ্রে দিয়ে যাই। সকাল ৯ টা থেকে দুপুর ২ টা পর্যন্ত আমার ভাতিজা হাবিবুর রহমান হিসাম এখানে নিরাপদে থাকে। দুপুরের টিফিন দিয়ে আমরা কাজে যাই। আমার ভাতিজা এখানের অন্যান্য শিশুদের সাথে খায়, খেলাধুলা করে, লেখাপড়া করে, ঘুমায়। এই শিশু যত্ন কেন্দ্র থাকায় আমাদের শিশুদের অনেক উপকার হয়েছে।
নজরা গ্রামের রহিমা খাতুন বলেন, আমাদের এই গ্রামে অনেক পুকুর আছে। এই কেন্দ্র হওয়ার আগে গ্রামের অনেক শিশু পুকুরে পানিতে ডুবে মারা গেছে। কিন্তু এখন কয়েক বছর যাবত কেউ আর পুকুরে ডুবে মরে না। এখানে আমার মেয়ে নুসরাতকে দিয়ে আমি খুব শান্তি ও নিশ্চিন্তে আছি। এখানে এসে আমার মেয়ের ছড়া বলার সাথে নাচও শিখেছে।
ধলাইপাড় গ্রামের সুমি আক্তার জানায়, তার আড়াই বছর বয়সের ছেলে ওমর ফারুক এই কেন্দ্রে আসার আগে কথা বলতে পারত না। চুপচাপ থাকতো। এখানে এসে সবার সঙ্গে মিশে অনেক ভালো হয়েছে, এখন কথা বলতে পাবে।
একই গ্রামের হাসি বেগম বলেন, আমার বাচ্চাটা এখানে এসে অনেক কিছু শিখেছে, আগে বাসায় মোবাইল চালাইতো এখন আর মোবাইল চালায় না। বাসায় এসেও খেলাধুলা করে এবং কেন্দ্রে যা শিখে আসে তা বাসায় এসে বলে।
দুখুনিয়া গ্রামের শরীফ মিয়া জানায়, শুনলাম কেন্দ্রটি নাকি ডিসেম্বরে বন্ধ হয়ে যাবে। এতে আমরা দুশ্চিন্তায় আছি। সরকারের কাছে দাবি এই শিশু যত্ন কেন্দ্রটি যেন চালু রাখা হয়।
এই কেন্দ্রের যত্ন কারী রত্না আক্তার বলেন, এক বছর থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের এই যত্ন কেন্দ্রে রাখা হয়। এই শিশুদের পরে অভিভাবকরা প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করতে কোন অসুবিধা হয় না। কারণ শিশুদেরকে এখানে থাকার সময় মোটামুটি অনেক কিছু শেখানো যায়। সকাল ৯ টা থেকে দুপুর ২ টা পর্যন্ত ২৫ জন শিশুকে এই সব যত্ন কেন্দ্রে নিরাপদে রাখা হয়। মায়েরা সংসারসহ বাহিরে অনেক কাজকর্ম নিশ্চিন্ত মনে সারতে পারে। এইদিকে আমাদেরও অনেক সুবিধা ঘর ভাড়া, কারেন্ট বিল সহ মাসে চার হাজার টাকা পাই। আরেকজন সহকারীর যত্ন কারি আছে, সে মাসে এক হাজার টাকা বেতন পায়। এভাবে আমরা মোটামুটি সুন্দরভাবে চলছি। তবে টাকার চেয়ে এই শিশুদের ভালোবাসা আমাদেরকে বেশ আনন্দ দেয়। যতক্ষণ এই শিশুদের নিয়ে থাকি ততক্ষণে আমাদের মন ও ভালো থাকে। কেন্দ্র থেকে বাড়িতে গেলে শিশুদের জন্য আমাদের মন খারাপ লাগে।
এই প্রকল্পের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রাম ম্যানেজার বিউটি পারভিন বলেন, ত্রিশাল উপজেলার তিনটি ইউনিয়নে ২০০ সেন্টারে শিশুদের প্রারম্ভিক বিকাশ ও সুরক্ষা দিয়ে যাচ্ছি। এতে প্রতিটি শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ হচ্ছে। এসব শিশু যখন বাসায় থাকে তখন তাদের মা বাবা নানান কাজ করার কারণে তাদের প্রতি পুরোপুরি খেয়াল রাখতে পারে না। এছাড়া শিশুদের সাথে কথা না বলতে পারায় তাদের মানসিক বিকাশও ঘটে না। কিন্তু এখানে শিশুরা এসে অন্যান্য শিশুদের সাথে খেলাধুলা সহ সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়। এতে সামাজিক বন্ধন ও বন্ধুত্ব বাড়ছে। এছাড়াও শিশুর মানসিক বিকাশেও দ্রুত প্রসার ঘটে। তাদের মধ্যে জড়তা ও ভয় কেটে যাচ্ছে। বাসায় থাকলে নানা ইনজুরিতে পড়ে কিন্তু এখানে সে ইনজুরিতে পড়ছে না। আমাদের মূল টার্গেট হচ্ছে শিশু মৃত্যুর ঝুঁকি কমানো। এখানে একসময় অনেক শিশু পুকুরে পড়ে মারা যেত এখন আর পুকুরের ধারে কাছে যায় না কেউ।
স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এবং সচেতন মহল জানায়, এই প্রকল্পের মাধ্যমে শিশু যত্ন কেন্দ্র গুলো সরকার যদি নিয়মিত করে যায় তাহলে পুরো দেশে শিশু মৃত্যুর হার কমার পাশাপাশি শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ দ্রুত ঘটবে। সেই সাথে তারা স্কুলে যাওয়ার আগেই অনেকটা দক্ষ ও মানসিকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠবে। এতে ভবিষ্যৎ জাতি গঠনে অন্যতম মাধ্যম হবে এই শিশু যত্ন কেন্দ্র।

আরো খবর

আপনার মতামত দিন