শেরপুর কন্ঠ ডেস্ক : ৫ আগস্ট পরবর্তি বিএনপি বনে যাওয়া শেরপুর নালিতাবাড়ী উপজেলার মেঘালয় সীমান্ত সংলগ্ন নয়াবিল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান এখন চোরাকারবারির ডন। বিগত ২০২১ সালে অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে বিএনপির নির্দেশনা অমান্য করে সাবেক ছাত্রদল কর্মী মিজানুর রহমান চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। পোষাক শ্রমিক থেকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েই আওয়ামীলীগের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়া এই চেয়ারম্যান রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর চোরাকারবারি করে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যান। এসব তথ্য এলাকার সাধারণ মানুষ, বিএনপি নেতাকর্মীসহ একাধিক সুত্র নিশ্চিত করেছে।
ফ্যাসিস্ট জামানায় তিনি ছিলেন আওয়ামীলীগের বিশ্বস্ত জনপ্রতিনিধি। আওয়ামীলীগের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তার অংশগ্রহন ছিল চোখে পড়ার মত। আওয়ামীলীগের নানা অনুষ্ঠানে ঘিরে জেলা ও উপজেলায় শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ হাসিনার ছবি সম্বলিত ব্যানারের সাথে নিজ ছবি সংযুক্ত করে নানা প্রচারানা চালান এই ইউপি চেয়ারম্যান। এক সময় অর্থাভাবে রিক্সায় ঘুরে বেড়াতেন, সংসার চালনোই ছিল তার কঠিন।
৫ আগস্ট পরবর্তি চেয়ারম্যন মিজান নিজস্ব নোয়া মাইক্রোবাস, নালিতাবাড়ী পৌরসভার আনসার ক্যাম্পের সাথে কোটি টাকার মুল্যের ১০ শতক জমি, তার ভাই শাহীনের নামে ফায়ার সার্ভিসের সাথে দেড় কোটি টাকা মূল্যের ১০ শতক জমি কিনেছেন। এছাড়াও গ্রামের বাড়ী নয়াবিলে পাঁচ একর জমি কিনেছেন।
৫ আগস্টের পরে প্রশাসনকে চ্যালেঞ্জ করে নালিতাবাড়ীর পাহাড় ও নদী থেকে কোটি কোটি টাকার অবৈধ লুটপাট করার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এসব বালু পরিবহণের জন্য মোট ৭টি ভেকু (প্রতিটির মুল্য ৩৫ লক্ষ্য), ৪টি ড্রাম ট্রাক(প্রতিটির মুল্য ২৮ লাখ) দু’টি ট্রাক (প্রতিটির মুল্য ২৮ লাখ)। ৫ আগস্ট অস্থির সময়ের শহরের উত্তর বাজার ভুমি অফিস সংলগ্ন লুবনা টিভিএস মোটর সাইকেলের শোরুমে ঢুকে ১৭টি মটর সাইকেল লুটপাট ও তিনটি গাড়ী পোড়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে নতুন রূপে জানান দেন এই চেয়ারম্যান। এসবের পাশাপাশি পাহাড়ে সরকারের মুল্যবান লাল বালু লুটপাটের সাথে জড়িয়ে যান। সীমান্তের ওপাড় থেকে জিরা, এলাচ, কম্বল, কসমেটিকসহ চোরোই পণ্যের বাণিজ্য শুরু করেন দেদারছে। ভারতীয় পণ্য চোরাকার বাড়ির পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে মানুষ পাচারেরও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ৫ আগস্ট পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে টাকার বিনিময়ে ফ্রাসিস্টদের অনেক বড় বড় নেতাকে ওপাড়ে পাড় করে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
৫ আগস্ট পরে টাকার দাপটে স্থানীয় পরীক্ষিত বিএনপি নেতাকর্মীদের আমলেই আনছেন না এই চেয়ারম্যান। নালিতাবাড়ির অসংখ্য বিএনপি নেতাকর্মীর অভিযোগ, মিজান চেয়ারম্যান চেয়ারম্যান তাদের সাম্রাজ্যকে সমৃদ্ধ করতে ইতিমধ্যে ক্যাডার বাহীনি তৈরি করেছেন। লুট করা ওই ১৭টি গাড়ী নিজস্ব বাহীনিকে দিয়েছেন। চেয়ারম্যান যেখানেই যান ওই বাহীনি মটরসাইকেল নিয়ে গাড়ীর আগে পিছে থাকে। মিজানের ভয়ে বিএনপি নেতারাও টুশব্দটি পর্যন্ত করতে পারে না।
সর্বশেষ গত ২৬ মে পরিবেশ ও বন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা শেরপুরের নালিতাবাড়ী দাওধারা কাটাবন পর্যটন কেন্দ্র পরিদর্শনে আসলে উপদেষ্টাকে পাথর উত্তোলন, অবৈধ বালু, বনের সরকারি গাছ লোপাট বিষয়ে প্রশ্ন করলে ক্ষেপে যান মিজান। তিনি পাহাড়ে পর্যটন করতে চান। কেন দাওধারাতে পর্যটন হবে না এমন প্রশ্নে উপদেষ্টার গাড়ি থামিয়ে বিক্ষোভ করেন মিজান বাহীনি। বালু পাথর নিয়ে প্রশ্ন করায় উপদেষ্টার গাড়ি বহরের পেছনে থাকা সাংবাদিকদের ব্যাপক মারধর ও লাঞ্চিত করে ইউপি চেয়ারম্যান মিজানের ভাড়াটিয়া ক্যাডাররা। সেসময় গুরুতর আহত হয় ৬ সংবাদকর্মী। পরদিন ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন ময়মনসিংহ রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি মোঃ আবু বকর সিদ্দীক। তদন্তে প্রমাণ মিললে নড়েচড়ে বসে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন।
এ বিষয়ে চেয়ারম্যান ও তার ভাইকে প্রধান অভিযুক্ত করে দ্রুত বিচার আইনে মামলা দায়ের করা হয়। মামলার পর থেকে গ্রেফতার আতংকে গাঁ ঢাকা দেয় চেয়ারম্যান মিজান। তবে সম্প্রতি উচ্চ আদালত থেকে ছয় সপ্তাহের জমিন এনে শতাধিক মটর সাইকেলের বহর নিয়ে ৯ জুন শহর ব্যাপি মহড়া দেন ডন মিজান। নাম না প্রকাশ করার শর্তে একাধিক সূত্র জানায়, মিজান এখন উপজেলা বিএনপির সভাপতি হতে মরিয়া।
নালিতাবাড়ী উপজেলা শ্রমিকদলের সাধারণ সম্পাদক সাহাদাৎ হোসেন সামাদ বলেছেন, ৫ আগষ্ট এর আগে অভাবের কারণে নিজের একটি টিভিএস মটর সাইকেল ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেন । কিন্তু ৫ আগষ্টের পরে সীমান্তের চোরাকারবাড়ি, কালো বাজারি, মামলা বানিজ্য করে এখন কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। আর ওই কালো টাকায় সম্প্রতি মিজানের মেয়েকে পড়াশুনার জন্য মালয়েশিয়া পাঠাচ্ছেন।
নালিতাবাড়ী উপজেলা ছাত্রদলের আহবায়ক বলেছেন, ৫ আগষ্টের পরে কয়েক কোটি টাকার বালু লুটপাট, জেলা ও স্থানীয় বেশ কয়েকজন আওয়ামীলীগের নেতা এবং কয়েকজন আমলাকে সীমান্ত দিয়ে ভারতের মেঘালয় পাড় করে দিয়েছেন।
নালিতাবাড়ী উপজেলা শ্রমিকদলের সহ-সভাপতি বলেছেন, মিজান চেয়ারম্যান বিএনপি নাম ভাঙ্গিয়ে এসব করে বিএনপিকে বিতর্কিত করেছে। এদের বিরুদ্ধে দল থেকে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত চেয়ারম্যান মিজান বলেছেন, সাংবাদিকদের সাথে যে ঘটনাটা সেটি অনাকাঙ্ক্ষিত, আমি এ বিষয়ে কিছুই জানিনা, যদিও এ ঘটনায় আমাকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। তারপরও আমি এই ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছি। আমারি দলের নেতা কর্মীরা আমাকে ফাঁসানোর জন্য এবং আমার জনপ্রিয়তায় ও রাজনীতিতে আমার এগিয়ে যাওয়ায় তারা আমার বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র করছে। আমি বিএনপি করি আগে থেকেই, এখনো করি, তাই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ভারতে পাচার করব কেন। বিষয়টির কোন ভিত্তি নেই। একটি কুচক্র মহল ও আমার দলের কতিপয় নেতা এসব মিথ্যে অভিযোগ এনেছেন। আমার বিরুদ্ধে যে সব কথা শুনেছেন বা অভিযোগ এনেছেন তার সবগুলোই মিথ্যে বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। এছাড়া আওয়ামীলীগের পক্ষে শুভেচ্ছা পোস্টার করার বিষয়টি এডিটিং করা হয়েছে বলে তিনি জানায়।